বিংশ শতকের আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য দিক হল তেল কূটনীতি। এর মূল নিয়ন্ত্রক ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। 1960 এর দশক থেকে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সচেষ্ট হয়ে ওঠে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে আমেরিকা প্রত্যক্ষ সমর কূটনীতিতে জড়িয়ে পড়ে, ফলে আমেরিকার খরচ বাড়ে এবং অর্থনীতিও দুর্বল হয়ে পড়ে এই দুর্বল অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য আমেরিকার বিদেশনীতি তে যুক্ত হয় এক নতুন বিষয় যার নাম "তেল কূটনীতি"।
প্রথম পর্যায়:- বিংশ শতকের সূচনালগ্নে মধ্যপ্রাচ্যে বিপুল পরিমাণ তেলের সন্ধান মেলে।এর পরেই তেলসমৃদ্ধ অঞ্চলগুলির দখলদারি নিয়ে ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। ব্রিটেন, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত রাশিয়াসহ একাধিক দেশ তেল কূটনীতি লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়ে যা চলে সমগ্র বিশ্ব জুড়ে তাই তেল কূটনীতি শতক হিসেবে চিহ্নিত হয়।
1. ব্রিটেন ও সোভিয়েত দখলদারি:- প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে ব্রিটেনের মধ্যপ্রাচ্যে তেলের দখলদারির ক্ষেত্রে প্রথম ছাড়পত্র পায়। এসময় রাশিয়াও তেল সংগ্রহে আগ্রহ দেখায়।বিদেশি সাহায্যে তেল উত্তোলনের লক্ষ্যে ব্রিটেন ও রাশিয়া মিলিত হয়ে ইরানের সঙ্গে এক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। এই চুক্তি অনুযায়ী ইরান এর উত্তর অংশে সোভিয়েত রাশিয়া এবং দক্ষিণাংশে ব্রিটেন নিজ নিজ দখলদারি চালু রাখবে।
2. মার্কিন অংশীদারিত্ব কায়েম:- প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ অঞ্চল হস্তগত করা নিয়ে পশ্চিমী দেশগুলির মধ্যে তীব্র দ্বন্দ্ব বাঁধে। এই দ্বন্দ্ব চলাকালে আমেরিকার টনক নড়ে । আমেরিকা উপলব্ধি করে তার নিজের সঞ্চিত তেল আগামী দিনের জন্য যথেষ্ট নয় তাই আমেরিকা মধ্যপ্রাচ্যে তেলের ভাগাভাগিতে নিজেকে জুড়ে দেয় এবং শেষ পর্যন্ত কিছুদিন টানাপোড়েনের পর টার্কিশ পেট্রোলিয়াম কোম্পানির ওপর মার্কিনী অংশীদারিত্ব কায়েম হয়।
3. আন্তর্জাতিক সমস্যার রূপান্তর:- এই সময়
মধ্যপ্রাচ্যে এই তেল কূটনীতিকে কেন্দ্র করে রাশিয়া, ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পারস্পারিক দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয় ফলে তেল কূটনীতি আন্তর্জাতিক সমস্যায় রূপান্তরিত হয়।
4. ইরানের সংসদীয় ঘোষণা ও আইন:- ইরান এই সমস্ত কান্ড দেখে ঘোষণা করে যে ইরানের মাটি থেকে সমস্ত বিদেশি সৈন্য সরিয়ে না নেওয়া পর্যন্ত কোনো আলোচনা তেলের অধিকারকে কেন্দ্র করে ইরান করবে না ।এরপরই ইরান তেল অনুসন্ধান ও উত্তোলনের দায়িত্ব নিজের হাতেই নিয়ে নেয় এবং খনি গুলোকে জাতীয়করণ করে।
দ্বিতীয় পর্যায়:-
ইরানের এই ঘোষণায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ক্ষুব্দ হয়ে ওঠে এবং ইরানের বিরুদ্ধে আর্থিক অবরোধ ঘোষণা করে। পরবর্তী সময়ে এই তেল কূটনীতি কে কেন্দ্র করে যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হয়।
1. ইরাক ইরান যুদ্ধ:- 1979 খ্রিস্টাব্দে ইরানে শিয়া নেতা খোমেইনীর নেতৃত্বের ইরানে শুরু হয় মার্কিন বিরোধিতা। এই পরিস্থিতির মোকাবিলায় লক্ষ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগান ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ নীতি গ্রহণ করে। এক্ষেত্রে তিনি ইরানের বিরুদ্ধে ইরাককে ব্যবহার করেন । মার্কিন সাহায্য নিয়ে ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম 1980 খ্রিস্টাব্দে ইরান আক্রমন করে ।এতে বহু অনার মুসলিম ও ইরানের সেরা মারা যায়।
2. কুয়েত যুদ্ধ:- ইরান-ইরাক যুদ্ধের 10 বছর পরে ইরাক কুয়েত এর উপর আক্রমণ চালায়।বহুদিন ধরে OPEC নির্ধারিত দামের চেয়ে অনেক কমে কুয়েত তেল বিক্রি করছিল এতে ইরাক সহ অন্যান্য আরব দেশের ক্ষতি হচ্ছিল।আমেরিকাও এই সময় সুযোগ সন্ধানী হয়েছিল। তাই যখনই ইরাক কুয়েত আক্রমণ করে তখনই আমেরিকা 28 টি ইউরোপীয় রাষ্ট্রের সেনাবাহিনী নিয়ে ইরাককে আক্রমণ করে এই অসম লড়াইয়ের একমাস পরে ইরাক-কুয়েত ত্যাগ করতে বাধ্য হয়।
3. ইরাক মার্কিন যুদ্ধ:- তেল কূটনীতি কে কেন্দ্র করে ইরাক মার্কিন বিরোধ ক্রমাগত বজায় থাকে।আমেরিকায় ছিল ইরাকে তেলের ভান্ডার গুলি নিজের নিয়ন্ত্রণে আনতে। মার্কিন রাষ্ট্রপতি জর্জ বুশ পারমাণবিক ও রাসায়নিক অস্ত্র মজুদ রাখার অজুহাতে ইরাক আক্রমণ করেন। ইরাক পরাজিত হয় এবং সাদ্দাম হোসেন গদিচ্যুত হন এবং তাকে ফাঁসি দেয়া হয়। যুদ্ধশেষে মার্কিন রাষ্ট্রপতি নয়া বিশ্ব বিন্যাসে ধারণা ঘোষণা করেন যা ছিল আসলে একমেরু বিশ্বের মার্কিন প্রভুত্ব প্রভূত্ব বাদের ঘোষণা কারণে ইতিমধ্যেই 1991 খ্রিস্টাব্দে সোভিয়েত রাশিয়া ভাঙ্গন হয়ে গেছে।
মূল্যায়ন:- এই ভাবে দেখা যায় যে তেল কূটনীতিকে কেন্দ্র করে বার বার সংঘর্ষ হয়েছে এবং বৃহত্তর রাষ্ট্রগুলির ক্ষমতা দখলের লোভ ক্রমাগত পরিস্ফুটন ঘটেছে। বর্তমানেও সেই একই ধারা অব্যাহত। এখনো একে কেন্দ্র করে ক্রমাগত যুদ্ধ লেগেই রয়েছে।
No comments:
Post a Comment